সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা
এখানে যা থাকছে---
- সাপে কাটালে করণীয়
- সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা
- সাপে কামড়ালে বাধার নিয়ম
- সাপে কামড়ালে যা করা উচিত
সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসা |
সাপ কেন কামড়ায়ঃ
সাপে কামড়ানোর অনেক কারণ রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সাপ (Snakes) মাবুষকে কামড়ায় না। রেগে গিয়ে অথবা বিপদে পড়ে সাপ কামড় দেয়। যে সকল কারণে সাপ মানুষকে কামড়ায় তা নিম্নরূপ -
- ১. খাদ্য খুজতে গিয়ে সাপ মানুষের সামনাসামনি চলে এলে, মানুষ দেখে পালাতে গেলেও পালাতে না পারলে, ভয় পেলে বা আত্মরক্ষার জন্য সাপ বাধ্য হয়ে মানুষকে কামড়ায়।
- ২. অন্ধকারে বা অসতর্ক অবস্থায় চলতে গিয়ে কোনো কারণে সাপের গায়ে পাড়া পড়লে সাপে কাটতে পারে বা সাপে কামড়াতে পারে।
- ৩. বর্ষা কালে চারিদিকে জলাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সাপ শুষ্ক জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, ফলে বসতবাড়িতে এসে সাপ আশ্রয় নিতে পারে, বসতবাড়িতে কোনো ক্রমে সাপের সামনা সামনি মানুষ চলে এলে সাপ ভয় পেয়ে মানুষকে ছোবল দিতে পারে।
- ৪. শীত মৌসুমে সাপ রোদ পোহাতে গর্ত থেকে বের হয়ে আসে ফলে সাপের চলা চলের স্থানে হঠাৎ কেও পড়লে রেগে গিয়ে অথবা ভয় পেয়ে কামড় বসাতে পারে।
- ৫. জমির আইল বা চারিদিকে জলাবদ্ধতার মাঝে সামান্য জমি থাকলে সাপ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে আর সেখানে সামনা সামনি মানুষ এসে পড়লে সাপে কাটতে পারে।
- ৬. লেপের মাঝে, বালিশের নিচে সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে, শোবার সময় সাপের গায়ে আঘাত লাগলে সাপ কামড় দিতে পারে।
সাপ ইচ্ছা করে মানুষকে কামড়ায় না, বাধ্য হয়ে এবং ভয় পেয়ে মানুষকে কামড়ায়।
সাপে কাটার লক্ষণঃ
আমাদের আশে পাশের বেশিরভাগ সাপি নির্বিষ সম্পন্ন। বিশাক্ত সাপের ২ টি বিষদাঁত থাকে। ছোবল মারার সাথে সাথে বিষদাঁত দিয়ে বিষ থলিতে থাকা বিষ বা টক্সিন নের হয়ে আসে। যদিও বিষাক্ত সাপে কাটার লক্ষণ বোঝা খুবি কঠিন তার পরেও নিম্নের লক্ষণ গুলো দেখে ধরে নেওয়া যেতে পারে কাওকে বিষাক্ত সাপে কামড়েছে-
- ১. বিষাক্ত সাপের বড়শির মতো বাকা বড় বড় দুটি বিষদাঁত থাকে তাই কামড় দিলে অন্যান্য দাত না বসলেও বিষদাঁত দুটি মাংসে বসে যায় এবং দুটি গভীর ক্ষত তৈরি হয়। ক্ষত দুটির মাঝে কিছুটা দুরত্ব থাকে।
- ২. যদি পাশাপাশি গাদা গাদি করে অনেক গুলো দাতের ক্ষত লক্ষ্য করা যায় এবং ক্ষত গুলোর মাঝে কিছুটা দুরত্বে দুটি ক্ষত লক্ষ্য করা না যায় তবে ধরা যেতে পারে বিষাক্ত সাপ নয়, তবে বিষদাঁতের চিহ্ন পাওয়া যাক বা না যাক সাপে কাটার অন্যন্য লক্ষণ প্রকাশ পেলে ধরে নিতে হবে বিষাক্ত সাপে কামড়েছে।
- ৩. কামিড়ের পর বিষাক্ত সাপ দেখতে পেলে ধরে নিতে হবে বিষাক্ত সাপে কেটেছে।
- ৪. কিছু কিছু বিষাক্ত সাপের বিষে নিউরোটক্সিন থাকে যা মাথা ঘোরায়, ঝিমুনি ভাব আনে, চোখে ঝাপসা দেখায়, চোখের পাতা ফুলে ওঠে, বমিবমি ভাব আসে অথবা বমি হয়, শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, এসব লক্ষণের যে কোনো একটি প্রকাশ পেলে ধরে নিতে হবে বিষাক্ত সাপে কেটেছে।
- ৫. কিছু সাপ আছে যেমন চন্দ্রবোড়া সাপ যার বিষে রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ফলে রক্ত বমি শুরু হতে পারে, নাক, কান, গলা দিয়ে রক্ত বের হতে পারে, এমন লক্ষণ প্রকাশ পেলে ধরে নিতে হবে বিষাক্ত সাপে কামড়েছে।
সাপে কাটলে বাঁধন দিতে হবে |
সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
বিষাক্ত সাপে কাটার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে সাপে কাটা রোগীর দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা (First Aid) শুরু করতে হবে। সাপে কাটার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার আগপর্যন্ত যে সকল প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয় তা নিম্নরূপ -
- ১. মানুষ ভয় পেলে হার্ট এটাক করতে পারে। তাই বিষাক্ত বা নির্বিষ যে ধরণের সাপে কামড়াক না কেন রোগী যাতে ভয় পেয়ে হার্ট এটাক না করে সে জন্য ভয় না দিয়ে মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
- ২. সাপ হাতে কামড়ালে হাত নড়াচড়া করতে বারন করতে হবে, পায়ে কামড়ালে হাটাচলা বন্ধ করতে বলতে হবে, অর্থাৎ যেখানেই কমড়াক, সাপে কাটলে নড়া চড়া কম করা উচিৎ যাতে বিষ সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
- ৩. সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে প্রধান কাজ হলো কাটা স্থান থেকে কিছুটা উপরে নরম ও মসৃণ কাপড় বা মোটা সুতা দিয়ে মাঝারি টাইট বা হালকা শক্ত করে বেধে দিতে হবে যাতে বিষ সহজে উপরে না ওঠে, বাধা স্থানে যেন কাপড় বা দড়ির নিচ দিয়ে ২ আংগুল প্রবেশ করতে পারে তেমন ঢিলা থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেশি টাইট করে বাধলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পচন ধরতে পারে এবং রোগী পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
- ৪. দড়ি বা কাপড় দিয়ে হাল্কা করে বাধার পর সাবান দিয়ে কাটা স্থান ধুয়ে ফেলতে হবে।
- ৫. গাড়ি, ভ্যান, এম্বুলেন্স বা যে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুত সাপে কাটা রোগিকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
- ৬. সাপ দেখতে পেলে কোন ধরণের সাপে কেটেছে তা রোগীর নিকট থেকে শুনে রাখতে হবে যাতে ডাক্তার কে বলা যায়, এতে ডাক্তার দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন।
- ৭. সাপে কামড়ানোর পর শরীর ফুলে যেতে পারে তাই হাতে চুড়ি আংটি এসব থাকলে খুলে ফেলতে হবে নইলে সেখানে পচন ধরতে পারে।
সাপে কাটলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে |
সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাঃ
ডাক্তার সাপে কাটা রোগীর দংশীত স্থান ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে চেষ্টা করবেন বিষাক্ত সাপ কিনা বা কোণ ধরণের সাপ। সাপের ধরণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাপের বিষনাশক বা এন্টিভেনাম দিবেন। এন্টিভেনাম দেওয়ার পরো উন্নতি না হলে অন্য ধরণের এন্টিভেনাম দিয়ে চিকিৎসা শুরু করবেন। এভাবে এন্টিভেনাম প্রয়োগ করে ডাক্তার সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করবেন। এন্টিভেনাম প্রয়োগের সাথে সাথে ডাক্তার অন্যান্য লক্ষণ অনুযায়ী ব্যবস্থা ও চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। আশা করা যায় সাপে কাটার পর দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। বেশিরভাগ রোগী মারা যায় দেরিতে এবং রোগীর শেষ পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার ফলে।
সাপে কাটলে যা করা ঠিক নয়ঃ
কাওকে সাপে কাটলে যা করা ঠিক নয় তা নিম্নরূপ-
- ১. সাপে কাটলে বেশি নড়াচড়া করা যাবে না এতে বিষ কম ছড়াবে।
- ২. বেশি শক্ত করে বাঁধন দেওয়া যাবে না, রক্ত চলচল করতে পারে এমন হাল্কা করে বাধতে হবে। রক্ত চলা চল বন্ধ হলে অবশ হয়ে পচন ধরতে পারে অথবা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
- ৩. সাপে কাটলে ওঝা বা গুনিন এর কাছে যাওয়া যাবে না, ওঝা সাপে কাটা রোগী ভালো করতে পারে না, ওঝার কাছে যেয়ে যে রোগী ভালো হয় সে রোগী ওঝার কাছে না গেলেও ভালো হয়ে যেত।
- ৪. সাপে কাটলে কাটা স্থানে ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কাটা যাবে না, মুখ দিয়ে রক্ত বের করা যাবে না, এসব করলে বিষ ছড়িয়ে পড়ে রোগী মারা যেতে পারে।
- ৫. যদি বোঝা যায় বিষাক্ত সাপ নয় তবুও হাসপাতালে যেতে হবে, নইলে ধারণা ভুল হলে সমস্যা হতে পারে।
- ৬. কাটা স্থানে কার্বোলিক এসিড লাগানো যাবে না, গাছ গাছড়া, হলুদ, লবণ কিছুই লাগানো যাবে না।
- ৭. কামড়ানোর পর সাপকে ধরতে যাওয়া যাবে না, পারলে চিনে রাখতে হবে যাতে ডাক্তারের এন্টিভেনাম দিতে সহজ হয়।
- ৮. কামড়ানো স্থানে সাপের দাত ভেংগে থাকলে তা আলতো করে তুলে কোথাও পুতে না রেখে ফেলে রাখা যাবে না।
সাপের কামড় থেকে বাচার উপায়ঃ
সাপে কাটা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। রাতে কোথাও চলতে গেলে টর্চ লাইট ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আশে পাশের বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ি সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। রাতে শোয়ার সময় লেপের নিচ, কাথা, বালিশের নিচ ভালো করে ঝেড়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে। আলনা, দেরাজ বা আলমারি থেকে কাপড় বা কিছু আনতে গেলে সতর্ক থাকতে হবে এবং শব্দ করে যেতে হবে যাতে সাপ আগে থেকে সরে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে রাতে মাছ ধরতে গেলে অবশ্যই টর্চ ব্যবহার করতে হবে এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
নিচের বক্সে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের নিকট খুবি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার কমেন্টের উত্তর আমরা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের সাথেই থাকুন।
1timeschool.com
EmoticonEmoticon