গরুর গলা ফোলা রোগের ঔষুধ চিকিৎসা ও করণীয়
এখানে যা থাকছে---
- গরুর গলা ফোলা রোগের ওষুধ
- গরুর গলা ফোলা রোগের চিকিৎসা
- গরুর গলা ফোলা রোগের আয়ুর্বেদী ও ঘরোয়া চিকিৎসা
- গরুর গলা ফোলা রোগের হোমিও চিকিৎসা
গরুর গলা ফোলা চিকিৎসা |
গরুর গলা ফোলা রোগ কিঃ
গলা ফোলা রোগে সাধারণত গরুর গলার নিচে এমনকি গরুর চোয়াল, কানের নিচে বা চোখ বা নাক বা মুখমণ্ডল ফুলে ওঠে। অনেক সময় গরুর তলপেট ফুলে উঠতে দেখা যায়। ফোলা অনেকটা গুড়গুড়ি বা বলের মত দেখায়। এই রোগে গরুর গলার নিচে বলের মত ফুলে ওঠে বলে একে গলা ফোলা রোগ বলে। গলা ফোলা রোগ কে অনেকে গরুর টুটি ফোলা রোগ, গরুর চোয়াল ফোলা রোগ, গরুর গলগটু, গরুর ঘটু রোগ, গরুর ব্যাংগা রোগ বা গরুর গলবেরা রোগ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে এ রোগ কে গরুর Hemorrhagic Septicemia রোগ বা গরুর HS রোগ বলা হয়।
গরুর গলা ফোলা রোগের কারণঃ
Hemorrhagic Septicemia বা গরুর গলা ফোলা রোগ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জনিত মারাত্মক রোগ গুলোর অন্তর্ভুক্ত। গরুর শরীরে বসবাসকারী Pasteurella Multocida (6:B) নামক গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে গরুর গলা ফোলা রোগ দেখা দেয়। Pasteurella Multocida নামক ব্যাকটেরিয়া অনেক সময় সুস্থ গরুর শরীরে স্বাভাবিক ভাবেই বসবাস করে। দীর্ঘকাল গরু অপুষ্টিতে ভুগলে এই ব্যাকটেরিয়া অধিক সক্রিয় হয়ে গরুর শরীরে অধিক হারে আক্রমণ করতে শুরুকরে ফলে এক পর্যায়ে গলা ফোলা রোগ দেখা দিতে পারে। সাধারন্ত অধিক ঠান্ডা জনিত সমস্যা বা অধিক গরম জনিত সমস্যার পর গরু দূর্বল হয়ে পড়লে বা পরিবহণ জনিত ক্লান্তি বা অনাহারক্লিষ্ট দূর্বলতার পর বা ক্রিমি জনিত কারণে গরু অপুষ্টিতে ভুগলে Pasteurella Multocida ব্যাকটেরিয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয় এবং একপর্যায়ে গলা ফোলা রোগ দেখা দেয়।
গরুর গলা ফোলা রোগ প্রবণ এলাকা ও মৌসুমঃ
সমগ্র এশিয়া, ইউরোপের দক্ষিণের দেশ সমূহ, সমগ্র আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে গরুর গলা ফোলা রোগের প্রকোপ দেখা গেলেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সমুহে গরুর গলা ফোলা রোগ বেশি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র এ রোগ পরিলক্ষিত হলেও গরুর খাদ্য সংকট প্রবল অঞ্চল ও বর্ষা মৌসুমে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
গরুর গলা ফোলা রোগের প্রকারভেদঃ
গরুর গলা ফোলা রোগের ব্যাকটেরিয়াল আক্রমণের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে ও আক্রমণের লক্ষণ ভেদে ২ ধরণের গলা ফোলা রোগ পরিলক্ষিত হয়, যথা-
- ১. গরুর স্বল্প মাত্রার গলা ফোলা রোগ
- ২. গরুর তীব্র মাত্রার গলা ফোলা রোগ
যে সকল গরুতে স্বল্প মাত্রার লক্ষণ প্রকাশ পায় সে সকল গরুর মৃত্যু হার কম থাকে। কিন্তু তীব্র মাত্রার গলা ফোলা রোগ প্রকাশ পেলে গরুর মৃত্যু হার অধীক হয়।
গরুর স্বল্প মাত্রার গলা ফোলা রোগের লক্ষণঃ
- ১. গরুকে দেখতে ক্লান্ত ও দূর্বল মনে হয়।
- ২. চোখে ময়লা জমে পিচুটি পড়তে পারে।
- ৩. গরু খাওয়া কমিয়ে দিতে পারে এবং শীর্ণকায় হয়ে পড়তে পারে।
- ৪. গলা বা চোয়ালের নিচে বল আকৃতির ফুলে ওঠে, ফোলা স্থান শক্ত ও বেদনা যুক্ত হয় এবং সিরিঞ্জের সুচ দিয়ে ছিদ্র করলে ভিতর থেকে হলুদ বর্ণের রস বেরিয়ে আসে।
- ৫. গরুর তল পেট ফুলে উঠতে পারে।
- ৬. শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং জিহ্বা বের করে হাপাতে পারে বা কাশতে পারে।
- ৭. গলা ফুলে ওঠায় গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ হওয়ার সাথে কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
- ৮. গরুর গায়ে মাঝারি মাত্রার জ্বর থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।
- ৯. ফোলা স্থানে হাত দিলে গরু ব্যথা পায় এবং হাতে গরম অনুভূত হয়।
- ১০. স্বল্প মাত্রায় গরুর গলা ফোলা রোগ হলে রোগ দেখা দেওয়ার ৪৮ ঘন্টার মাঝে বা ৪৮ ঘন্টা পর গরু মারা যেতে পারে অর্থাৎ গরু লক্ষণ প্রকাশের পর ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত বেচে থাকতে পারে, এ সময়ের মাঝে দ্রুত চিকিৎসা করালে গরু সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
গরুর তীব্র মাত্রার গলা ফোলা রোগের লক্ষণঃ
- ১. গরুকে দেখতে ক্লান্ত ও দূর্বল মনে হয়।
- ২. গরুর গায়ে হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর দেখা দেয়, জ্বরের মাত্রা ১০৬° থেকে ১০৭° এর বেশি উঠে যেতে পারে।
- ৩. মারাত্মক সংক্রমণ হলে গরুর নাক, মুখ বা গাল দিয়ে লালা ঝরতে থাকে।
- ৪. গলা ফুলে উঠতে পারে বা নাও পারে।
- ৫. হঠাৎ লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং লক্ষণ প্রকাশের ২৪ ঘন্টার মাঝে বা ২৪ ঘন্টা পর গরু মারা যেতে পারে, অর্থাৎ গরু লক্ষণ প্রকাশের পর ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বেচে থাকতে পারে, এ সময়ের মাঝে দ্রুত চিকিৎসা করালে গরু সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
গরুর গলা ফোলা রোগে সতর্কতাঃ
গরুর গলা ফোলা রোগে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কোনো গরুতে গলা ফোলা রোগের স্বল্প মাত্রার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত গরু বেচে থাকতে পারে। অপরদিকে কোনো গরুতে তীব্র মাত্রার গলা ফোলা রোগ দেখা দিলে অর্থাৎ হঠাৎ তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও গাল বা নাক দিয়ে লালা ঝরা শুরু করার পর ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত গরু বেচে থাকতে পারে। তাই গরুর যে কোনো প্রকার গলা ফোলা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান ছাড়া গরুকে বাচিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
গরুর গলা ফোলা রোগের ওষুধ ও চিকিৎসাঃ
গরুর গলা ফোলা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা না করালে বা দেরিতে চিকিৎসা করালে গরুকে বাচানো সম্ভব হয় না। তাই লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে নিম্নের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে-
- ১. ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন যেমন, Penicillin গ্রুপের ইঞ্জেকশন Ampicillin 500ml vet inj. অথবা Tetracycline গ্রুপের ইঞ্জেকশন A-Tetra vet inj. অথবা Erythromycin গ্রুপের ইনজেকশন অথবা Sulfonamide গ্রুপের ইঞ্জেকশন লেবেলে থাকা মাত্রা ও নির্দেশনা অনুযায়ী গরুর মাংশে প্রয়োগ করতে হবে।
- ২. গলায় ফোলা বা স্ফিতি দেখা দিলে সিরিঞ্জের সুচ দিয়ে ফুটো করে চেপে চেপে রস বের করে দিতে হবে।
- ৩. গরুর গায়ে জ্বর নিবারণে Paracitamol গ্রুপের ইঞ্জেকশন যেমন, Feversol 500ml vet inj. লেবেল বা ইঞ্জেকশনের গায়ে লেখা নির্দেশ ও মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
গরুর গলা ফোলা রোগের টিকা বা ভ্যাকসিনঃ
গরুকে টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে গলা ফুলা রোগ প্রতিরোধ বা এ রোগ থেকে গরুকে মুক্ত রাখা সম্ভব। গরুর গলা ফোলা রোগের টিকা বা ভ্যাকসিনের ২ টি স্ট্রেইন বা ধরণ বা প্রকার রয়েছে। দেশ ভেদে একেক ধরণের টিকা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে উভয় প্রকার টিকা গলা ফোলা রোগের জন্য ভালো কার্যকর। যে কোনো প্রকার টিকা ব্যবহার করা যেতে পারে। গরুর গলা ফোলা রোগের টিকা গুলো হল-
- ১. Plain Broth Bacterins অথবা Alum Precipitated এবং Aluminium Hydroxide Gel জাতীয় ভ্যাকসিন।
- ২. Oil Adjuvant ভ্যাকসিন বা OAV ভ্যাকসিন।
গরুর গলা ফোলা রোগের টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগের নিয়মঃ
Alum Precipitated ভ্যাকসিন ৪ থেকে ৬ মাস অন্তর অর্থাৎ বছরে ২ বার গরুর মাংসে প্রয়োগ করতে হয়। অপর দিকে Oil Adjuvant ভ্যাকসিন বা OAV বছরে ১ বার অর্থাৎ প্রতি বছর একবার করে গরুর গলায় চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হয়। OAV ভ্যাকসিন বছরে ১ বার প্রয়োগ করতে হয় বলে কিছুটা ঝামেলা মুক্ত এবং গরুকে এই ভ্যাকসিন দেওয়াই উত্তম। OAV মাংসে প্রবেশ করলে মাংসে পচন ধরতে পারে তাই সাবধানে গরুর গলার চামড়া টেনে ধরে ঠিক চামড়ার নিচে প্রয়োগ করা উচিত।
গরুর গলা ফোলা রোগের টিকার দাম ও প্রাপ্যতাঃ
গরুর গলা ফোলা রোগের টিকা বা ভ্যাকসিনের মূল্য বা দাম খুবি কম। স্বল্প মূল্যে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে অথবা বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন ফার্মেসী থেকে গরুর গলা ফোলা রোগের ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা যেতে পারে। স্বল্প মূল্য ও সহজ প্রাপ্যতা থাকায় ঝুকি এড়াতে নিয়মিত গরুকে ভ্যাকসিন বা টিকা প্রয়োগ করা উচিত।
গরুর গলা ফোলা রোগের আয়ুর্বেদী, হোমিও ও ঘরোয়া চিকিৎসাঃ
গরুর গলা ফোলা রোগের দ্রুত চিকিৎসা করাতে হয়। তাই আয়ুর্বেদী, হোমিও ও ঘরোয়া চিকিৎসায় তেমন সুফল পাওয়া যায় না। তবে সহযোগ ওষুধ হিসেবে এলোপ্যাথি চিকিৎসার পাশা পাশি হোমিও ওষুধ হিসেবে "এপিসমিল-২০০" ও "রাসটক-২০০" সেবন করানো যেতে পারে। গরুর স্বাভাবিক স্বল্প মাত্রার গলাফোলা রোগে হোমিও ওষুধ দুটি ভালো কার্যকর। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সাথে সাথে গরুর ফোলা স্থান সিরিঞ্জের সুচ দিয়ে ফুটো করে অবশ্যই রস বের করে দিতে হবে।
গরুর গলা ফোলা রোগ প্রতিকারের উপায় ও করণীয়ঃ
- ১. সুস্থ গরুকে নিয়মিত ভ্যাকসিন বা টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
- ২. অসুস্থ গরুকে দ্রুত সুস্থ গরু থেকে আলাদা করে নিতে হবে।
- ৩. কোনো অঞ্চলে গলা ফোলা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গরুর চলাচল নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
- ৪. নিয়মিত গোয়াল ঘর বা গরুর খামার ও এর আশেপাশে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে।
- ৫. আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তনের সময় গরুর বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
- ৬. গরুকে নিয়মিত কৃমি মুক্ত করতে হবে।
- ৭. গরুর অপুষ্টি রোধে নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
- গরুর গলা ফোলা একটি ছোঁয়াচে রোগ তাই সুস্থ গরুকে কোনো ক্রমেই অসুস্থ গরুর ব্যবহৃত বস্তু, চলার পথ ও সংস্পর্শে আসতে দেওয়া যাবে না।
চিকিৎসা সম্পর্কিত যে কোনো জিজ্ঞাসা ও মতামত নিচে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।
নিচের বক্সে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের নিকট খুবি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার কমেন্টের উত্তর আমরা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের সাথেই থাকুন।
1timeschool.com
EmoticonEmoticon