মাংসের রেজালা রান্নার নিয়ম - শাহী রেজালা
এখানে যা থাকছে---
- রেজালা রান্নার রেসিপি
- রেজালা রান্নার সহজ পদ্ধতি
- গরুর মাংসের রেজালা
- খাসির মাংসের রেজালা
- মুরগীর মাংসের রেজালা
- শাহী রেজালা রেসিপি
রেজালা রান্নার নিয়ম |
বিয়ে পার্বণ বা যে কোনো অনুষ্ঠানে মুখরোচক খাবার হিসেবে রেজালা অনন্য। ঈদ বা কোরবানি (কুরবানি) বা যে কোনো মেজবানি বা বিয়ে বাড়িতে রেজালা হতে পারে খুবি স্পেশাল রেসিপি। রেস্টুরেন্ট বা হোটেলের শাহী রেজালার ১০০% স্বাদ পেতে আজকের রেজালা রেসিপি মনযোগ সহকারে অনুসরন করুন।
রেজালা কি বা কোন ধরনের খাবারঃ
রেজালা (Rezala বা Rejala) সুস্বাদু খাবার গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি সাধারন্ত ঝাঁঝালো বা ঝালযুক্ত মাংস রান্নার পদ্ধতি। বর্তমানে রেজালা রান্নায় লাল মরিচ ব্যবহার করায় এর রং সাধারণত লাল হয়ে থাকে। রেজালার প্রধান উপকরণ মরিচ হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক রন্ধন পদ্ধতিতে এর অন্যতম উপাদান গুলোর মধ্যে জায়ফল ও জয়ত্রী যোগ করা যেতে পারে। অনেকে রেজালা রান্নায় শাহী জিরা ব্যবহার করে থাকেন। রেজালা যেহেতু ঝাঁঝালো ঝাল মশলাযুক্ত মাংস রান্নার প্রণালী, তাই এটি জাংক ফুড বা ফ্যাটি ফুডের অন্তর্গত এক ধরনের রেসিপি। বর্তমানে নানান প্রকারের রেজালা পাওয়া যায়। গরুর মাংসের রেজালা, খাসির মাংসের রেজালা, মুরগীর মাংসের রেজালা এমনকি মাছের রেজালা খুবি জনপ্রিয়। মাছের রেজালার মধ্যে ইলিশ মাছের রেজালা, চিংড়ি মাছের রেজালা, কাতল মাছের রেজালা, রুই মাছের রেজালা বেশি জনপ্রিয়। সাধারণত কোরমা রান্নার পদ্ধতির মাঝে মরিচ বা ঝাল যোগ করে ঝাঁঝালো করলেই রেজেলা রান্না হয়ে যায়। মোঘল আমলে মোঘল'রা ঝাল যুক্ত খাবার পছন্দ করতো না। কোরমা পোলাও ছিলো তাদের খুবি প্রিয় খাবার। অপর দিকে স্থানীয় লোকেরা বা কর্মচারী পর্যায়ের লোকেরা ঝালযুক্ত খাবার পছন্দ করতো। কোরমা রান্নার প্রক্রিয়ার মাঝে স্থানীয় লোকেরা ঝাল যোগ করে রেজালা রান্নার উৎপত্তি ঘটায়।
রেজালা শব্দের উৎপত্তিঃ
ফরাসি শব্দ, 'রিদালা' থেকে বিবর্তনের মধ্যদিয়ে 'রেজালা' শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। মোঘল আমলে উপমহাদেশে নিম্নবিত্ত বা কর্মচারী পর্যায়ের লোকেদের একটি জনপ্রিয় খাবার ছিল রেজালা। নিম্নবিত্ত শব্দ হিসেবে মোঘল আমলে 'রাজিল' শব্দটি ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ তখনকার দিনে রেজালা ছিলো নিম্নবিত্ত সমাজ তথা কর্মচারী পর্যায়ের লোকেদের খাবার। 'রাজিল' শব্দ যেহেতু 'নিম্নবিত্ত' শব্দের সমর্থক শব্দ, 'নিম্নবিত্তদের খাবার' অর্থে তাই 'রাজিল' থেকে 'রাজিলা' শব্দের উৎপত্তি ঘটে। 'রাজিলা' শব্দটি উচ্চারণগত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে 'রেজালা' শব্দে পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তীতে রেজালা শুধু নিম্নবিত্ত নয়, সকল সমাজ ও সকল শ্রেণীর ভোজন প্রিয় লোকের কাছে খুবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে রেজালা সুস্বাদু খাবার হিসেবে ছোট বড় সবার খুব প্রিয়। আধুনিক রেজালা রান্নার রেসিপিতে, ঝালযুক্ত মরিচ, জায়ফল, জয়ত্রী সহ অন্যান্য মশলার মিশ্রণ সহযোগে মাছ-মাংসের কোরমা রান্নার প্রক্রিয়া কে রেজালা বলে।
রেজালা রান্নার আজকের রেসিপিঃ
আগেই জেনেছি রেজালা মাছ-মাংস রান্নার বিশেষ এক পদ। মাংসের ভিন্নতা আর মাছের ভিন্নতার কারনে রেজালা রান্নার নামকরণে ও স্বাদে ভিন্নতা হয়ে থাকে। আমাদের আজকের রেসিপি, 'রেজালা রান্না' বা 'শাহী রেজালা' রান্নার পদ্ধতি। শতভাগ শাহী প্রক্রিয়ায় শাহী স্বাদ পেতে রেজালা রান্নার সহজ রেসিপিটি অনুসরণ করতে পারেন।
রেজালা রান্নার উপকরণ সমূহের পরিমাপ পদ্ধতিঃ
- চা চামচ- চা চামচ বলতে ছোট্ট চামচ কে বোঝানো হয়। সাধারণত আমরা পিরিজ বা প্লেটে করে যে চামচ দিয়ে সেমাই খাই সে রকমের চামচ কে চা চামচ বলে। লবণ, চিনি বা চা পাতা যে ওঠাতে যে ধরনের চামচ ব্যবহার করা হয় তাকে চা চামচ বলে।
- টেবিল চামচ- টেবিল চামচ বলতে সাধারণত ঝোল বা কারি বা রান্না করা তরকারি ওঠাতে আমরা যে ধরনের চামচ ব্যবহার করি সেই ধরনের চামচ কে বোঝানো হয়ে থাকে।
শাহী রেজালা বা রেজালা রান্নার উপকরণঃ
- মাংস-১কেজি (গরু, খাসি, মুরগী বা যে কোনো মাংস হতে পারে)
- দই- ২ চা চামচ (টক দই হতে হবে)
- আদা বাটা- ২ চা চামচ
- রসুন বাটা- ১ চা চামচ
- পেয়াজ বাটা- ১ টেবিল চামচ
- কাঁচামরিচ অথবা শুকনা মরিচ- ৫-৭ টা অথবা স্বাদ মতো (ফালি করে কেটে মরিচের বীজ ফেলে দিতে হবে)
- দুধ- ১ টেবিল চামচ
- পেয়াজ কুচি- ১ টেবিল চামচ (গোল করে কাটতে হবে)
- কাঠবাদাম- ৪-৫ টি (কুচি করে কেটে নিতে হবে)
- পেস্তাবাদাম- ৫-৭ টি (কুচি করে কেটে নিতে হবে)
- গোলাপজল- ১ চা চামচ
- জাফরান- ১ চিমটি
- ঘি- ১ টেবিল চামচ
- কিসমিস- ১০-১৫ টি (কম-বেশি করা যেতে পারে)
- লবণ- স্বাদ মতো
- তেল- ২ টেবিল চামচ
- পানি- পরিমাণ মতো
শাহী রেজালা বা রেজালা রান্নার প্রক্রিয়াঃ
- ১. বীজ ফেলা মরিচ দুধে ভিজিয়ে রাখুন। সাথে মাংস মেরিনেট করে রাখুন। মাংস মেরিনেট করতে নিচের ধাপ অনুসরণ করুন।
- ২. আদা বাটা ও রসুন বাটার সাথে কিছু পরিমাণ লবণ দিয়ে মাংসের সাথে ভালো করে মাখিয়ে সাথে টক দৈ যোগ করে আরো ভালো করে মাখিয়ে ১-২ ঘন্টা রেখেদিন এই প্রক্রিয়াকে মেরিনেট করা বলে এতে মাংস থেকে দূর্গন্ধ দূর হয় এবং মাংসের স্বাদ উন্নত হয়।
- ৩. চুলায় কড়াই বা প্যান বসিয়ে তাতে অর্ধেক ঘি দিন এবং কুচি করে কেটে রাখা পেয়াজ ঘি সহকারে বাদামী করে ভেজে উঠিয়ে রাখুন। এই প্রক্রিয়াকে পেয়াজের বেরেস্তা বলে।
- ৪. মেরিনেট করা মাংসের সাথে পেয়াজ বাটা, ভালো করে মেখে নিন।
- ৫. একটি হাড়িতে বাকি অর্ধেক ঘি ও তেল দিয়ে অল্প আচে কয়েক সেকেন্ড নাড়ুন।
- ৬. এবার পেয়াজ মাখানো মেরিনেট করা মাংস এবং তুলে রাখা পেয়াজের বেরেস্তা হাড়ির তেল-ঘি এর মাঝে ছাড়ুন।
- ৭. কয়েক মিনিট মাঝারি আচে রাঁধুন এবং ভালো করে নেড়ে দিন।
- ৮. এবার মাংসে সামান্য পরিমাণে পানি যোগ করুন যেন তাতে মাংস সেদ্ধ হয়ে যায় কিন্তু সেদ্ধ শেষে বেশি ঝোল না থাকে। এই অবস্থায় ঢাকনা দিয়ে রান্না করতে হবে এবং স্বাদ মতো এমন ভাবে লবণ যোগ করতে হবে যেন ঝোল শুকিয়ে গেলে মাংসে লবণের পরিমাণ ঠিক থাকে।
- ৯. মাংস সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ তাপে রাধতে থাকুন মাঝে মাঝে নাড়তে থাকুন এবং মাখা মাখা ঝোল হলে চুলার তাপ কমিয়ে দিন।
- ১০. কয়েক মিনিট মাঝারি আচে রান্নার পর চুলার আচ কিছুটা কমিয়ে আরো কিছু সময় রান্না করতে থাকুন।
- ১১. হালকা আচে রান্নার পর মাংস ভুনা ভুনা হয়ে ঘ্রাণ ছড়াতে থাকলে এর মাঝে দুধে ভেজানো মরিচ বা ঝাল সহ দুধ এর সবটুকু মাংসের হাড়িতে ঢেলে দিন এবং নাড়ুনি দিয়ে ভালো করে নাড়িয়ে মিশিয়ে দিন।
- ১২. মাঝারি আচে কিছু সময় রাঁধুন যেন দুধের কাচা ঘ্রাণ না থাকে এবং মাংসে ঝোল মাখা মাখা হয়ে ওঠে।
- ১৩. চুলা থেকে মাংসের হাড়ি নামিয়ে বাকি উপকরণ গুলো একে একে মাংসের মাঝে যোগ করুন। অর্থাৎ রান্না করা মাংসে গোলাপজল, কাঠবাদাম কুচি, পেস্তাবাদাম কুচি, কিসমিস ও জাফরান মিশিয়ে নাড়ুনি দিয়ে নেড়ে ঢাকনা দিয়ে আধা থেকে এক ঘন্টা ঢেকে রাখুন।
- ১৪. এবার ঢাকনা খুলে পোলাও বা বিভিন্ন উপকরণ সহকারে পরিবেশন করুন মজাদার ও সুস্বাদু রেজালা বা শাহী রেজালা।
রেজালা তৈরির বাড়তি টিপসঃ
রেজালা তৈরিতে এর উপাদান গুলো নিজের পছন্দ ও স্বাদ অনুযায়ী পরিবর্তন করা যেতে পারে। মরিচ কম বেশি করা যেতে পারে। কাঠবাদাম বা পেস্তাবাদাম না থাকলে ব্যবহার নাও করা যেতে পারে। কিসমিস না দিলেও চলবে। আধুনিক রেজালা তৈরিতে জয়ত্রী ও জায়ফল এবং শাহী জিরা ব্যবহার করা যেতে পারে। উপরের রেসিপিটি শাহী রেজালা রান্নার রেসিপি বা পদ্ধতি হওয়ায় উপাদান গুলোর মাঝে জায়ফল ও জয়ত্রী ও জিরা অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। রেজালা স্বাস্থ্য উপযোগী করতে তেল, ঘি, মশলা কম করে রান্না করা যেতে পারে।
রেজালা পরিবেশনের উপকরণঃ
রেজালা সাধারণত পোলাও ভাত এর সাথে পরিবেশন করা হয়। বাসমতী চালের ভাতের সাথেও পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তবে সাধারণ যে কোনো চালের সাদা ভাতের সাথেও রেজালা পরিবেশন করা যেতে পারে। রুটি, পরাটা সহকারেও রেজালা খুব মুখরোচক। রেজালা ভাতের সাথে সালাদ যোগ করে খাওয়া যেতে পারে। দৈ যোগেও খাওয়া যায়। পছন্দ মতো রুচিশীল ভাবে রেজালা যে কোনো উপায়ে পরিবেশন করা যেতে পারে।
রেজালা খাওয়ার উপকারিতাঃ
রেজালা সাধারন্ত মাংস রান্নার একধরণের পদ। রেজালা রুচিবর্ধক হওয়ায় যে কোনো বয়সের লোক এটা তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকে। মাংসে থাকে প্রচুর আয়রন যা শরীরের রক্ত বর্ধক হিসেবে কাজ করে। মাংসে থাকা বিরোফ্রবিন, ভিটামিন বি৬, বি১২ সহ নানারকম উপাদান শরীরে শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি শরীর চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করে। রেজালায় মাংস থাকায় সেটা খনিজের অন্যতম উৎস হতে পারে। মাছ মাংসের রেজালা আমিষের ঘাটতি পুরোনে সহায়তা করে।
রেজালা খাওয়ার অপকারিতাঃ
রেজালা খাওয়ার ক্ষতিকারক কিছু দিক রয়েছে। রেজালা সাধারণত মসলা ও তেল - চর্বি যুক্ত খাবার। অধিক পরিমাণে রেজালা খেলে শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ফ্যাট ও জাংক খাবার হওয়ায় মোটা বা স্থূলাকার লোকের জন্য বর্জনীয়। ছোট ও বয়ষ্কদের এ ধরনের খাবার না খাওয়ায় উত্তম। চর্বি যুক্ত খাবার হওয়ায় রেজালা হৃদ রোগ ঘটাতে সহায়তা করে। রেজালা মশলাযুক্ত খাবার হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও শারীরিক বিপাকীয় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই যাদের স্বাস্থ্যগত ঝুকি রয়েছে তাদের রেজালা খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
শুভকামনায়---
কে-মাহমুদ
৫-৭-২১
নিচের বক্সে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের নিকট খুবি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার কমেন্টের উত্তর আমরা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের সাথেই থাকুন।
1timeschool.com
EmoticonEmoticon